এম. এ. সাঈদ
জার্মানির নাৎসিবাদি নেতা হিটলার এবং ইতালির মুসোলিনির পর বিশ্বে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার অন্যতম আইকন ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল। ২০০৯ সালের ক্ষমতায় বসে একটানা তিনটি নির্বাচন শুধু লোক দেখানো নির্বাচন আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এককভাবে কিংবা রাতের ভোটে ও ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের ভোটের অধিকার সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়েছিল।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একমাত্র উপায় কি নির্বাচন?
===============================
যেহেতু বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলা দলটি তার নিজের ১৪ দলীয় জোটের বাইরে আর কাউকে ক্ষমতায় না আসার সুযোগ দিতে একদলীয়, রাতের আঁধারে, এবং ডামি নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের ভোটাধিকার বা মত প্রকাশের অধিকার হরণ করেছিল। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শুধু কি নির্বাচনেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একমাত্র পদ্ধতি? গণতান্ত্রিক কাঠামোর মানদন্ডগুলো কি? শুধুই কি নির্বাচন নাকি এর সাথে থাকে মত প্রকাশের অধিকার, মৌলিক মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, ন্যয় বিচার নিশ্চিত করন, প্রভৃতি। এই ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থায় শুধু নির্বাচন নয় বরং বাকি গণতান্ত্রিক কাঠামো গুলোরো কোন অস্তিত্ব ছিল না। যেগুলোর সম্মিলিত রূপই হচ্ছে গণতন্ত্র। যেগুলোর আশায় ছাত্র-জনতা ২০২৪ এর বিপ্লবে আত্মদান, রক্তদান কিংবা অঙ্গদান করেছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার জন্য কি শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ একাই দায়ী?
=================================
শেখ হাসিনার শাসনামলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার খর্ব, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই সেই আদিম যুগের পৈশাচিক নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন, গুম, হত্যা, আয়না ঘরে বন্দী করে ১৮ কোটি মানুষের উপর যে স্টিম রোলার চালানো হয়েছিল সেগুলোর জন্য কি শেখ হাসিনা কিংবা তার দল আওয়ামী লীগ একাই দায়ী নাকি এর সাথে বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলায় জড়িত ব্যক্তিবর্গ, দেশের সর্বোচ্চ বাহিনীর সম্পৃক্ততা, ও এই ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করতে রাজনৈতিকভাবে যারা সমর্থন করেছিলেন তারাও দায়ী?
ছাত্র-জনতার বিপ্লবে হাসিনার পতন হলেও ফ্যাসিবাদ নির্মূল হয়েছে কি?
===============================
শেখ হাসিনা একজন ব্যক্তি ছিলেন, একটা দলের প্রধান ছিলেন কিন্তু এটা মনে রাখা উচিত তার একক নির্দেশে বা একক ক্ষমতাবলে দেশটি ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েনি। বরং তার এই ফ্যাসিবাদী চিন্তাভাবনা কে বাস্তবে রূপান্তর করতে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র, এদেশীয় সরকারি এজেন্ট, সরকারি আমলা, প্রশাসন, সর্বোচ্চ বাহিনী ও রাজনৈতিক দল সকলের দায় রয়েছে। কিন্তু বিচার হয়েছে কয়জনের? কয়জনকে আটক বা গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে? দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে তৈরি করা ফ্যাসিবাদের কাঠামো কি ভেঙ্গে গিয়েছে? অফিস আদালতগুলোতে কি ঘুষ নাই হয়ে গিয়েছে? সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কি বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব হয়েছে? তাহলে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলাফল টা কোথায়? বিশেষ করে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বহির্বিশ্বে এই গণতান্ত্রিক কাঠামো দেখানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের অধীনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে লোক দেখানো নির্বাচন গুলো করা হয়েছিল সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের যে ১৪ দলীয় জোট ছিল তাদের কয়টার বিচার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে? বা ঐসব দলের দলীয় প্রধান কিংবা দলগুলিতে অবস্থান করা মূল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এ পর্যন্ত? যদি না হয় তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্জনটা কোথায়? তারা কোন কাজে সফল হয়েছে এখন পর্যন্ত? বিপ্লবের ফলাফল কি? কিংবা প্রায় ২০০০ ছাত্র-জনতার জীবন দান ও প্রায় অর্ধলক্ষ ছাত্র জনতার অঙ্গ হানির মাধ্যমে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার মূল্য কোথায়, বা প্রাপ্তি কি?
ফ্যাসিবাদের পতনের পর ১৪‑দলীয় জোটের আওতায় বর্তমানে দু’টি দল‑এর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলছে। যদিও আরও কিছু শরিক দলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার নিরীক্ষা চলছে, তবে বর্তমানে সক্রিয় ও সরাসরি বিচারমূলক পরিস্থিতিতে আসা দল শুধু এই দুইটি।
প্রথমতঃ ওয়ার্কার্স পার্টি – এর সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা সহ একাধিক নেতা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও বিচারাধীন ।
দ্বিতীয়তঃ জাসদ – সভাপতিদের মধ্যে হাসানুল হক ইনু জেলবন্দি এবং সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার প্রায়ই আত্মগোপনে; তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক মামলার তদন্ত ও বিচার চলছে ।
বাকি আরো যে ১১ টি দল বিশেষ করে বৃহৎ দল হিসেবে জাতীয় পার্টি যদি এই আওয়ামী লীগের সাথে না থাকতো তাহলে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ কায়েমের স্বপ্ন কখনোই পূরণ হতো না সেই জাতীয় পার্টি সহ ১১ টি দলের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে? ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টির সহ সেই সময় ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করা রাজনৈতিক দলগুলো মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এবং সরকারের সমালোচনায় মুখর। এই উদ্দেশ্যেই কি ছাত্র জনতা জীবন দিয়েছে, আহত বা পঙ্গু হয়েছে? গাছ কেটে যদি বীজ সরিয়ে রাখা হয় তাহলে সেই বীজ থেকে পুনরায় যে ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে?
বিপ্লব তথা অভ্যুত্থানকারী ছাত্র জনতা ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাঙ্গন
===============================
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর রাজনৈতিক দলগুলো ও ছাত্র জনতার মধ্যে ইতিমধ্যে যে ভাঙন দেখা দিয়েছে তাতে করে তারা ভবিষ্যতে কি সফল হতে পারবে? কি দরকার ছিল ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ বিদায়ের পর ছাত্রদের নতুন করে রাজনৈতিক দল গঠন করা যতক্ষণ না এ দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের শিকড় উপড়ানো সম্ভব হবে? বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিপ্লব পরবর্তী সময়ে একটা বিপ্লবী বাহিনী গঠন করে সারা দেশে আগের অবস্থান ধরে রাখতে পারত না? যুগে যুগে যেসব দেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে প্রত্যেকটি দেশেই এই বিপ্লবী বাহিনী বা একটা সংঘ তৈরি হয়েছে। সরকার কিংবা বিরোধী দল যখনই বিপথগামী হতো তখনই তাদেরকে সোজা পথে আনার জন্য এই বিপ্লবী ছাত্র জনতার বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত না? না করে তারাও দল গঠন করার পর রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনার যেমন পতন হয়েছে, তেমনি ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী অনৈক্যের সুর স্পষ্ট হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আধিপত্যবাদী ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার যে রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর ধরে গোলামী করে আসছিল সেই গোলামীর জিঞ্জির আবার গলায় পড়তে গেলে তা ঠেকাবে কে? কারণ ছাত্র জনতার যে ঐক্যবদ্ধ শক্তি সেটা এখন দলে রূপান্তরিত হয়েছে। এদেশে একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে ছাত্র-জনতা না হয়ে যদি কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতা করে তাহলে তাকে দমন-নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ধ্বংস করা হয়। যে কারণে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই, হেফাজত কিংবা এবি পার্টি সহ অন্যান্য যেসব রাজনৈতিক দল ছিল তারা এককভাবে কিংবা ঐক্যবদ্ধভাবেও শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে পারেনি। তাহলে ভবিষ্যতে আবারো ফ্যাসিবাদ ফিরে আসলে তা কি রাজনৈতিক দল দ্বারা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে? এমন প্রশ্ন করা মনে হয় অবান্তর নয়।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কি তার নিজের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে?
=================================
বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে কম-বেশি প্রায় প্রত্যেকটি দেশই যেখানে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে সেই সময় বর্তমান বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরে এক অস্থির সময় পার করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার চাইলেও দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসন থেকে বাঁচতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ কিংবা এর প্রয়োজনে যুদ্ধ সরঞ্জাম তথা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহ প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি কিনতে গিয়েও অদৃশ্য ইশারায় তা বারবার বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে কিংবা চুক্তিগুলো করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের অস্তিত্ব কি হুমকির সম্মুখীন নয়? ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তাদের সামনে পিছনে তাকানোর তো কোন প্রশ্ন আসে না, কারণ তারা কোন অদৃশ্য শক্তির কাছে দায়বদ্ধ নন। তারা এদেশের ১৮ কোটি মানুষ তথা ছাত্র জনতার কাছে দায়বদ্ধ। সুতরাং তারা কিছু করতে না পারলেও অন্তত দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য ১৮ কোটি ছাত্র জনতা যে সংগ্রাম করে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আগ্রাসী আধিপত্যবাদের কবল থেকে যে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাকে রক্ষার জন্য জল,স্থল ও আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যা করা দরকার সেটা করবেন তা না হলে তারা ভবিষ্যতে অনাগত পরাধীনতার জন্য ১৮ কোটি মানুষের কাছে চিরকাল দায়ী থাকবেন।
নির্বাচনের মাধ্যমে যেভাবে ফিরতে পারে আওয়ামী লীগ
=================================
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিংবা সাধারণ আদালতে বিচার চলাকালীন আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধ হওয়া কিংবা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ায় সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। বিশেষ করে তার দলের লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী কিংবা সমর্থক কিন্তু হারিয়ে যায়নি , হয়তো চুপ করে আছে কিন্তু ভোটের অধিকার তো আর খর্ব হয়নি। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার সহযোগী হিসেবে যেসব রাজনৈতিক দল ও নেতা-কর্মী সহ প্রশাসনিক এবং আমলাতান্ত্রিক ও বিচার ব্যবস্থায় যারা এখনো যুক্ত তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় না আনতে পারলে ভবিষ্যতে এই সব দল ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভোট সেই বাক্সে দিয়ে আবারও যে ক্ষমতায় আসবে না আওয়ামী লীগ এই গ্যারান্টি কে দেবেন? বিশেষ করে জাতীয় পার্টি এবং সিপিবি কিংবা অন্য যেকোন ছোট রাজনৈতিক দল যদি আগামী নির্বাচনে যাদের নিবন্ধন রয়েছে তারা যদি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে কৌশলে আওয়ামী লীগের সকল ভোট সেই বাক্সে দিতে বলে তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচন করা বিএনপি এবং ইসলামী দলগুলো তাদের আলাদা আলাদা ভোট দিয়ে কি সেই আওয়ামীলীগের ভোটের বাক্স ঠেকাতে পারবেন? এমন প্রশ্ন করা মনে হয় অমূলক হবে না।
লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।